Svoboda | Graniru | BBC Russia | Golosameriki | Facebook

অ্যাকসেসিবিলিটি লিংক

ভারতে কি করে চালু হয়েছিলো নির্বাচনী প্রতীক


ভারতে কি করে চালু হয়েছিলো নির্বাচনী প্রতীক
ভারতে কি করে চালু হয়েছিলো নির্বাচনী প্রতীক

বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে ২০১৩ সালে ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজনীতি তাপ ছড়াতে থাকে। প্রধান দুই প্রতিপক্ষ কংগ্রেস ও বিজেপি একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে রোজ ছুটছে নির্বাচন কমিশনের দুয়ারে। তবে, দুপক্ষই অমুলক অভিযোগ তুলছে বেশি। বিরক্ত নির্বাচন কমিশন দুই দলকেই সতর্ক করেছে; বলেছে, মিথ্যা, বানোয়াট অভিযোগ করলে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

নির্বাচন কমিশনের এমন সতর্কবাণীতেও কান দেয়নি কোনো পক্ষ। ইন্দোরের অদূরে এক গ্রামে কংগ্রেস আবিষ্কার করলো বিশাল পুকুর ভর্তি পদ্ম ফুল। আর, পুকুরের এক ধারের স্কুলটাই ভোট গ্রহণ কেন্দ্র। তারা কমিশনের কাছে দাবি জানায়, ভোট গ্রহণের আগে পুকুরকে পদ্মশূন্য করতে হবে। সংগ্রেসের যুক্তি, পদ্ম বিজেপির প্রতীক। মানুষ পদ্ম ভর্তি পুকুর দেখে বিজেপিতে ভোট দিতে বাড়তি আগ্রহ পেয়ে যেতে পারে।

জবাবে বিজেপি নির্বাচন কমিশনকে বললো, পুকুর থেকে পদ্ম তুলে নিলে, কমিশন যেন কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের হাতের কব্জি ঢেকে রাখতে আদেশ দেয়। কারণ, হাত কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক।

এই বিবাদে নির্বাচন কমিশন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। প্রতীক নিয়ে এমন বিবাদ, বিড়ম্বনার নজির আরো আছে ভারতে। আম আদমি পার্টি সৃষ্টির পর প্রথম নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক ঝাড়ু চেনাতে, রাস্তাঘাট ঝাঁট দেয়ার কর্মসূচি নিয়েছিলো। হাজার হাজার ঝাড়ু কিনে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করে তারা। বিজেপি ও কংগ্রেস, দুই দলই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পার্টির বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ করেছিলো তখন।

ভারতে কি করে চালু হয়েছিলো নির্বাচনী প্রতীক
ভারতে কি করে চালু হয়েছিলো নির্বাচনী প্রতীক

নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে বিবাদ শুরু হয়, যদি কেনো দলে ভাঙন দেখা দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা এবং এনসিপিতে ভাঙন দেখা দেয়। নির্বাচন কমিশন শিবসেনার তীর-ধনুক এবং এনসিপি’র ঘড়ি প্রতীক বরাদ্দ করে যথাক্রমে একনাথ শিন্ডে এবং অজিত পাওয়ারকে। দলের আনুষ্ঠানিক নামও বরাদ্দ হয় ওই দুই নেতার অনুগত উপদলের নামে।

দলে ভাঙন দেখা দিলে, নির্বাচন কমিশন অনেক সময় প্রতীক বাতিল করে দেয়। অর্থাৎ, বিবদমান দুই গোষ্ঠীকে বলা হয় নতুন প্রতীক বেছে নিতে। এই ধরনের রায় নির্ভর করে বিবাদ কতটা গুরুতর তার ওপর।আর, এই সব বিবাদ, বিতর্ক থেকে অনুধাবন করা যায়, ভোটে রাজনৈতিক দলের কাছে প্রতীক কতটা গুরুত্বপূর্ণ আইডেন্টিটি বা পরিচিতি।

প্রশ্ন হলো, ভারতে নির্বাচনে প্রতীকের ব্যবহার কেন এবং কবে চালু করা হয়। ভারতে প্রথম নির্বাচন হয়েছিলো ব্রিটিশ শাসনামলে, ১৯২০ সালে। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকার গঠনের সেই নির্বাচনে সব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ভোটাধিকার ছিলো না। ভোটাধিকার ছিলো না নারীদের।

শুধুমাত্র সরকারকে কর দেন এমন নাগরিকরা তখন নির্বাচনে অংশ নিতে পারতেন। স্বাধীনতার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচনে, লোকসভার সঙ্গে রাজ্য বিধানসভাতেও ভোটগ্রহণ করা হয়েছিলো এক সঙ্গে। তখন, ১৯৫০-এর জনপ্রতিনিধিত্ব আইনে বলা হয়েছিলো ২১ বছর বা তার বেশি বয়সের যে কোনো নাগরিক ভোট দিতে পারবেন।

পরে, ১৯৮৭ সালে আইন সংশোধন করে ভোটার হওয়ার বয়স তিন বছর কমিয়ে ১৮ করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ভোটার হতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন নেই। সাক্ষর, নিরক্ষর, নারী-পুরুষ সকলের ভোটাধিকার আছে ভারতে।

১৯৫১-’৫২ সালে, প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভোটার তালিকা তৈরি হয়। এ সময় ভোটদানের গুরুত্ব এবং পদ্ধতি শেখাতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। কারণ, ব্যালট পেপারে শুধু প্রার্থী ও তাদের দলের নাম লেখা থাকলে ৮৫ ভাগ মানুষেরই ভোট দেয়া কঠিন হতো। দেশের সাক্ষর মানুষ তখন মাত্র ১৫ শতাংশ।

পরিস্থিতি সামাল দিয়ে, প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন অনেক আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে আলাদা আলাদা প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। শুধু তাই নয়, সদ্য স্বাধীন দেশের সাধারণ মানুষের সুবিধার কথা বিবেচনায় রেখে তিনি ভোটপ্রদান কক্ষে প্রত্যেক প্রার্থীর জন্য আলাদা আলাদা ব্যালট বাক্স রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন। বাক্সের গায়ে সেঁটে দেয়া হয়েছিলো দলের প্রতীক।

সেই ব্যবস্থা পরের ভোটেই আর থাকেনি। প্রথম নির্বাচনের জন্য ২০ লাখ ব্যালট বাক্স তৈরি করাতে হয়েছিলো। বিশিষ্ট লেখক, শিক্ষাবিদ ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার রামচন্দ্র গুহ তার ‘ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’ বইয়ে লিখেছেন, ওই সংখ্যক ব্যালট বাক্স তৈরি করতে আনুমানিক আট হাজার দু’শো টন স্টিলের পাত খরচ করতে হয়েছিলো।

প্রতীক দিয়ে ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে চেনানোর সিদ্ধান্ত হওয়ার পর, রাজনৈতিক দলগুলো প্রতীক নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। তারা বুঝতে পারে, নির্বাচনে জেতার আসল চাবিকাঠি হলো এমন প্রতীক, যা মানুষ দৈনন্দিন জীবনে দেখে।

ভারতের নব্বই শতাংশ তখন গ্রাম। নিরানব্বই শতাংশ মানুষের পেশা চাষাবাদ। চারদিকে লাঙলের ছড়াছড়ি। সেই ভারতে চাষে ট্র্যাক্টরের ব্যবহার দিবাস্বপ্নের মতো। প্রতীক বণ্টনের বৈঠকে তাই কংগ্রেস, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, কৃষক ও শ্রমিক পার্টি লাঙল প্রতীক দাবি করে। সেই বৈঠক হয়েছিলো ১৯৫১ সালের ২ জুলাই।

কংগ্রেসের দাবির বিরুদ্ধে বাকিরা এক সুরে প্রশ্ন তোলে যে দল এতকাল চরকা, চরকা করে, তারা এখন কেন লাঙল প্রতীক দাবি করছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেন সমস্যার সুন্দর সমাধান সূত্র বের করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন লাঙল প্রতীক কোনো দলকেই দেয়া হবে না।

এ কারণে কংগ্রেসের খুব একটা সমস্যা হয়নি। তারা গ্রামীণ ভারতের সামনে নিজেদের তুলে ধরতে লাঙলের কাছাকাছি প্রতীক পেয়ে যায়; জোয়াল কাঁধে জোড়া ষাঁড়। তখনকার ভারতে গবাদি পশুই ছিল কৃষিকাজের প্রধান ভরসা।

সোশ্যালিস্ট পার্টির জন্য বরাদ্দ হয় গাছ। হিন্দু মহাসভা তাদের পছন্দের ছুটন্ত ঘোড়া প্রতীক পেয়ে যায়। বিগত সাড়ে চার দশক ধরে হাতি বহুজন সমাজ পার্টির প্রতীক। প্রথম সাধারণ নির্বাচনে হাতি প্রতীক বরাদ্দ হয়েছিলো সিডিউলড কাস্ট ফেডারেশনের নামে। গত শতকের আটের দশকে সেই পার্টি বিলীন হয়ে তৈরি হয়ে বহুজন সমাজবাদী পার্টি।

প্রথম সাধারণ নির্বাচন থেকে বিগত ৭৩ বছরে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। বলা হয়, সংস্কার শব্দটি যদি কোনো ক্ষেত্রে একশো শতাংশ প্রযোজ্য হয়ে থাকে, তবে তা নির্বাচনী ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

ভারতের নির্বাচনে প্রযুক্তির ব্যবহারও চমকে দেয়ার মতো। ইভিএম এসে ভোটের গোটা ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে। তবে ভোট বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে মানেন, প্রতীক-ই ভারতের নির্বাচনের প্রাণভোমরা। রামচন্দ্র গুহ তাই প্রথম প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনকে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থার অখ্যাত হিরো বলে অভিহিত করে ছিলেন।

XS
SM
MD
LG